বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় বাংলাদেশের ১০,০৪৪ বিজ্ঞানীর মধ্যে শ্রীমঙ্গলের চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন।
শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সুত্র জানায়, সম্প্রতি বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের তালিকা প্রকাশ করেছে আলপার ডজার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্স র্যাংকিং। সারা বিশ্বের ২১৮টি দেশের ২২ হাজার ৫৭৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটের ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৯ জন বিজ্ঞানী ও গবেষক এই র্যাংকিংয়ে স্হান পেয়েছেন। এ তালিকায় বাংলাদেশের ২০৩টি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজার ৪৪ জন বিজ্ঞানী ও গবেষক স্হান করে নিয়েছেন। বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় দেশের সেরা বিজ্ঞানী নির্বাচিত হয়েছেন আইসিডিডিআরবি'র জ্যেষ্ঠ গবেষক এবং সংক্রমণ ও পরজীবীবিজ্ঞান গবেষণাগারের প্রধান বিজ্ঞানী রাশিদুল হক। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের গুগল স্কলারের রিসার্চ প্রোফাইলে আগের ৬ বছরের গবেষণার এইচ-ইনডেক্স, আই ১০ ইনডেক্স ও সাইটেশন স্কোরের ভিত্তিতে এ তালিকা প্রকাশ করে এডি সায়েন্টিফিক।
সুত্র জানায়, কৃষি ও বনায়ন, কলা-নকশা ও স্থাপত্য, ব্যবসায় ও ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ইতিহাস দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব, আইন, চিকিৎসা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানসহ মোট ১২টি ক্যাটাগরিতে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের সেরা গবেষক, মহাদেশভিত্তিক সেরা গবেষক এবং দেশভিত্তিক সেরা গবেষকের তালিকা প্রকাশ করা হয় এ র্যাংকিংয়ে। বাংলাদেশের ২০৩টি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬৬৪ জন তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন । একক বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সর্বোচ্চ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে শ্রীমঙ্গলে অবস্হিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিটিউটের অবস্থান ১২৬ তম।
এই প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী-গবেষকদের তালিকায় দেশের ১০ হাজার ৪৪ জন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ১৭০১ তম স্থানে রয়েছেন শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিটটের বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন। তিনি চা গবেষণা কেন্দ্রের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি প্রায় দীর্ঘ ১৭ বছর যাবত টেকসই ও নিরাপদ চা উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও তৈরি চায়ে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আধুনিক পেস্ট ব্যবস্থাপনায় চা শিল্পে তাঁর ভুমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের চায়ের পোকামাকড় নিয়ন্ত্রনে টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তা সরেজমিন ব্যবহার করাই তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র। তিনি পেস্ট ব্যবস্থাপনার ফলিত দিক ও প্রযুক্তিসমূহ বাগান পরিদর্শন, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে চা বাগানগুলোকে পৌছে দিয়ে থাকেন। যার সুফল চা বাগানগুলোও পাচ্ছে। তিনি বাগান মালিক, ব্যবস্থাপক, ক্ষুদ্র চা চাষি সকলের নিকট অতিপরিচিত ও সফল চা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে সমাদৃত।
আলপার ডজার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্স এর তথ্য অনুযায়ী, ড. শামীম আল মামুন এর গবেষণাপত্র ৪৫০ এর অধিক বার সাইটেশন করা হয়েছে। র্যাংকিং তালিকার ‘এইচ’ ইনডেক্স সূত্রে, বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ১৭০১ তম, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ১ লক্ষ ৬৯ হাজার ১১৭ তম এবং বিশ্বে ৮ লক্ষ ১১ হাজার ৭৪৪ তম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত জার্নালে ড. শামীম আল মামুন এর মোট ৪৭টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও জার্মানীর ল্যাম্বার্ড একাডেমী থেকে প্রকাশিত ২টি বই, স্প্রিঙ্গার সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ১টি বই এর অধ্যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এলসিভিয়র থেকে প্রকাশিত বই এর ১টি অধ্যায়ের লেখক। প্রথমবারের মতো উত্তরাঞ্চলের চায়ের আদ্যোপান্ত নিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর ‘সমতলের চা শিল্প’ শিরোনামে পূর্ণাঙ্গ বইটি ইতোমধ্যে গ্রাহকদের নিকট বহুল সমাদৃত হয়েছে। তাঁর গবেষণালব্ধ উদ্ভাবিত চায়ের আইপিএম প্রযুক্তিটি মুজিবশতবর্ষে প্রকাশিত ‘১০০ কৃষি প্রযুক্তি এটলাস’ বইটিতে স্থান করে নেয়।
উল্লেখ্য যে, ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে বিএসসিএজি (অনার্স) এবং ২০০৫ সালে কীটতত্ত্ব বিষয়ে ১ম শ্রেণীতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিউউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কীটতত্ত্ব) পদে যোগদান করেন। তিনি ২০১৩ সালে ঊর্ধবতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কীটতত্ত্ব) ও ২০২২ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কীটতত্ত্ব) পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। তিনি ২০১০ সালে কলম্বো প্লান স্কলারশিপের আওতায় ভারত থেকে গ্রেড এ+ সহ 'টি প্লান্টেশন ম্যানেজমেন্ট' এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা (পিজিডি) ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১৬ সালে চীন সরকারের অর্থায়নে চীনের ফুজিয়ান থেকে 'পলিউশন ফ্রি টি প্রোডাকশন টেকনোলজি' এর উপর বিশেষ উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। তিনি ২০১৭ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'বাংলাদেশে চায়ের লালমাকড় নিয়ন্ত্রনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন' শিরোনামে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। চা শিল্পের উন্নয়নে 'দুটি পাতা একটি কুঁড়ি' ও ‘সমতলের চা শিল্প’ মোবাইল অ্যাপ, 'ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল' ও ‘টি সফট’ তাঁর বিশেষায়িত উদ্ভাবন (ইনোভেশন)। তিনি দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থা ও সংগঠন যেমন- কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কীটতত্ত্ব সমিতি, বাংলাদেশ আগাছা বিজ্ঞান সমিতি, আমেরিকান কীটতত্ত্ব সমিতি, ইরানের মাকড়তত্ত্ব সমিতি, বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতি, বাংলাদেশ উদ্ভিদবিজ্ঞান সমিতি এর অন্যতম সদস্য। তিনি ২০২১ সালে ভারতের ভিডিগুড প্রফেশনাল এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্টস ক্যাটাগরিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’ এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড প্রদত্ত ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল বেস্ট মনোগ্রাম উইনার’ লাভ করেন। দাপ্তরিক কর্মসম্পাদনে সর্বোত্তম নিষ্ঠা, সততা, দায়িত্বশীলতা ও দক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ‘জাতীয় শুদ্ধাচার পুরষ্কার ২০২৩’ লাভ করেন শ্রীমঙ্গলের এই চা বিজ্ঞানী।
সূত্র : দৈনিক মানবজমিন
Commenti